সমন্বিত প্রচেষ্টায় রুখতে হবে সামাজিক অবক্ষয়

রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০১৯ | ৭:২৬ অপরাহ্ণ | 563

সমন্বিত প্রচেষ্টায় রুখতে হবে সামাজিক অবক্ষয়

ধর্ষণ একটি জটিল অপরাধ যা বিচার-বিশ্লেষণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই অপরাধটি সংঘটিত হয় এবং সব দেশেই এর যথাযথ রেকর্ড পাওয়া সত্যিই দুরূহ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেনের মতো উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের মাত্রা এতটাই প্রকট যে, এ দেশগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের দেশগুলোর তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে।

একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের ৩৬ শতাংশ নারী কোনো না কোনো উপায়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ মেয়ে কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। আর ব্রিটেনে ১৬ থেকে ৫৯ বছর বয়স্ক নারীর মধ্যে প্রতি ৫ জনের ১ জন কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এদিক বিবেচনায় আমাদের দেশের নারীরা অনেক মর্যাদার সঙ্গেই বসবাস করছেন এবং আমাদের সরকার নারী জাগরণে ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যথেষ্ট উদ্যোগও গ্রহণ করেছেন।

বর্তমানে প্রতিদিন খবরের কাগজ খুলে যে সংবাদটি সবার নজর কাড়ে এবং উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা হল ধর্ষণ। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। খবরটি নিঃসন্দেহে আমাদের সবার জন্য বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই কৌতূহলবশত সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের দেশের একটি লিস্টের জন্য গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম। উত্তরে পেয়েছিলাম, এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকা ১ম আর সুইডেন ২য় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে ৩য় ও ৪র্থ অবস্থানে। তবে আমাদের দেশে যে হারে ধর্ষণের খবর পত্র-পত্রিকায় আসতে শুরু করেছে, তাতে সচেতন নাগরিক মাত্রই শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।

দেশে শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যান আমার জানা নেই, তবে ধর্ষণের সঠিক পরিসংখ্যান জানা সত্যিই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এর প্রধান কারণ, এই রিপোর্টটির সঙ্গে শিশুটির ভবিষ্যৎ জড়িত। শিশুটির মা-বাবা তথা পরিবারের মান-সম্মান জড়িত। আমরা এখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস যেমন পাই না, তেমনি যারা সাহস করে প্রতিবাদ করছে; আমাদের সমাজ তাদেরকে যথাযথ শ্রদ্ধা জানিয়ে সম্মান করতে পারছে না।

ধর্ষণের তালিকায় পৃথিবীতে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ৫ম স্থানে। ভারতে গত ৬ মাসে ২৪ হাজারেরও বেশি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ভারতে শিশু ধর্ষণের প্রদেশের মধ্যে ১ম স্থানে রয়েছে উত্তর প্রদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ ৫ম স্থানে। তবে ভারতের পত্র-পত্রিকা জানিয়েছে এ সংখ্যা আরও বেশি, সাধারণত বহু শিশু ধর্ষণের রিপোর্ট ঋওজ করা হয় না। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে ধর্ষণের হার খুবই কম এবং আমাদের দেশে সব স্তরে নারীকে আমরা যথেষ্ট সম্মান করে থাকি। আর সে কারণেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে তা আমাদের হৃদয়ে তীরের মতোই বিদ্ধ হয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আর শিশু ধর্ষণের ঘটনায় আমরা খুবই মর্মাহত হই, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলি।

বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্ষণের মাত্রা সামান্য হলেও বেড়েছে এ কথা যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে অত্যন্ত তৎপর রয়েছে এবং যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থাও নিচ্ছে; সে কথা কারও অজানা নয়। সাংবাদিকরা রাতদিন অত্যন্ত কষ্ট করে বিস্তারিতভাবে সংবাদ প্রচার করছেন। জনগণের সচেতনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতি রাতেই কোনো না কোনো টিভি চ্যানেলে টকশো চলছে। বিজ্ঞ আলোচকরা ধর্ষণের বিষয়টি নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের কাছে উপস্থাপন করছেন। তাহলে প্রশ্ন হল, সবাই তো নানাবিধ পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে আমার এ বিষয়ে লেখার দরকারটা কী? সত্যিই ভাবার বিষয়।

ধর্ষণের বিষয়টি আমাদের তখনই ভাবিয়ে তোলে, যখন দেখি ধর্ষকের জামিনের জন্য তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান নির্লজ্জের মতো, সত্যিই খুব কষ্ট হয়। ধর্ষকের মা-বাবা, ভাই-বোন কি কেউ হতে চান? ধর্ষকদের মা পরিচয় দিতে চান? ধর্ষকের বাবা হয়ে কু-সন্তানের জামিনে সই করতে চান? পাড়া-মহল্লায় ধর্ষকের ভাই-বোন হিসেবে ঘুরে বেড়াতে চান? আমার মনে হয়, এটা আজ সমাজের জন্য একটা কঠিন প্রশ্ন?

আর এ সমাজের এখনই সময় এর উত্তর দেয়ার। তবে ধর্ষকের ধর্ষণের সাজা ভোগ করার পর সে যদি সমাজে সুস্থ মস্তিষ্কে ফিরে আসে, তবে পরিবার-সমাজ তাকে মেনে নিতে পারে; এতে কারও বাধা দেয়ার কথা নয়। বিশ্বজুড়ে একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।’ তবে এ ক্ষেত্রে পাপীকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের মৃত্যুর পর অনেক বাবা-মা সন্তানের লাশ নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। তবে আজ কেন শিশু ধর্ষকের জন্য মা-বাবা, ভাই-বোনরা ধর্ষকের জামিনের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়ান? বাংলায় একটা কথা আছে- ‘যার যায় সেই বোঝে।’ সত্যিই যে শিশুটি ধর্ষিত হচ্ছে, কেবল সেই বুঝতে পারে ধর্ষণের যন্ত্রণাটা কতটা নির্মম, কতটা ভয়াবহ। সে নির্বাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলে চলছে, ধর্ষকদের কি মা-বোন নেই। আজ ধর্ষিতার পক্ষে মানববন্ধন হয়, মিছিল হয়, টকশো হয়। আমি গত কয়েকদিন আগে একটি টকশো-তে একজন আলোচককে বলতে শুনেছি- এখন থেকে নিজের মেয়েকে ঘরের মধ্যে, বাড়ির মধ্যে, চোখে চোখে রাখার বিকল্প নেই। কথা শুনে মনে হয়, আমরা সমাজের বাইরে বসবাস করছি।

যে শিশুর মা-বাবা কাজ করেন, তার সন্তানের বাসায় একা থাকার বিকল্প নেই। নিু মধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের কথা বলাই বাহুল্য। তারা যেন শাঁখের করাতেই বসবাস করছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। একটি পরিবার তার শিশুদের বড় হতে সাহায্য করবে ও শিশুর মানসিক বিকাশে যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে, সমাজ গঠনে পরিবারের কোনো বিকল্প নেই।

তাই সর্ব প্রথম পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে ভালোবাসা নিয়ে। যথাযথ উপদেশ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিটি শিশুকে, যাতে বড় হয়ে কোনো অসামাজিক কাজে জড়িয়ে না পড়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ‘আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ কিন্তু আমরা যদি সব মেয়েশিশুকে বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে রেখে বা চোখে চোখে রেখে বড় করতে চাই তাহলে সেটা কি ঠিক হবে? আর শুধু যে শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, নানা বয়সের মেয়েরাও ধর্ষিত হচ্ছে।

মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়া এবং ফিরে আসা অথবা যেসব স্থানে মেয়েরা যাতায়াত করে, সেসব ক্ষেত্র কি নিরাপদ? আর আমাদের সমাজ, সমাজপতিরা কি তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে টক শোর মতো কথা বলবেন- আপনার মেয়েশিশুকে ঘরের মধ্যে দেখে-শুনে রাখুন। সেনাবাহিনীতে বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে আর তা হল- Last Trench Battle অর্থাৎ ‘শেষ পরিখার যুদ্ধ’।

শিশুকে ঘরের মধ্যে চোখে চোখে দেখে রাখা, বাইরে বের হতে না দেয়া, এটা তো আমাদের শেষ কথা বা ব্যবস্থা হতে পারে না। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থান আমাদের কারোরই অজানা নয়। তা হলে এতে ভয়ের কি আছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী কোনো ধর্ষককে ধরে ছেড়ে দিয়েছে বলে ইদানীং কোনো খবর আমার নজরে পড়েনি। নুসরাত হত্যার পর সারা দেশে এ ধরনের নরপশুদের বিরুদ্ধে সমাজের সব স্তরের মানুষ একত্রে জেগে উঠেছে। তাহলে ভয়ের কী কারণ আছে? পরিবার থেকে ধর্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। বলুন, কোনো ধর্ষক আমার বাবা-ভাই হতে পারে না। ধর্ষকের কোনো মা-বাবা, ভাই-বোন থাকতে নেই।

ধর্ষককে পরাভূত করতে আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টায় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। তাই পরিবারের বাবা-মা, ভাই-বোনদের ধর্মীয় শিক্ষা ও আদব-কায়দা পরিবারে নিশ্চিত করতে হবে। এরপর সমাজে মেয়েদের চলাচলের ব্যবস্থা নিরাপদ ও সম্মানজনক করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মের লেবাসধারী ভণ্ড ও প্রতারকদের চিহ্নিত করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মাদকের মতো জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সমাজপতিরা সব ধর্ষককে নিজেদের চারপাশ থেকে আবর্জনার মতো সরিয়ে ফেলবেন। এদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। জনগণ সোচ্চার হলে ধর্ষকের মনোবল ভেঙে পড়ে এবং দ্রুত সাজা পায়। জনসচেতনতার ফলে ধর্ষকের মাথা থেকে ধর্ষণের চিন্তা মুছে যায় এবং তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। যেসব বিনোদন আমাদের ধর্ষক হতে উৎসাহিত করে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ধর্ষণের দৃশ্য সংবলিত নাটক, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য বিনোদন সাময়িক বন্ধ রেখে শুধু ধর্ষকের সাজার কথা প্রচার করা শ্রেয় বলে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আচার-আচরণের একটি পিরিওডিক্যাল রিপোর্টিং সিস্টেমের প্রচলন করা উচিত। এই রিপোর্টটিতে শিক্ষকদের পাঠদানের সক্ষমতা, ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সর্বশেষ দৃষ্টিকটু কার্যকলাপ যদি থাকে, তার একটি কলাম থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য প্রতি ৬ মাস অন্তর ১০ জন ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক থেকে একটি ছোট মন্তব্যপত্র লেখার রীতিনীতি চালু রাখারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এ বিষয়গুলো সামনে এলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যেমন সতর্ক হবেন, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা অপকর্ম রোধ হবে।

সবশেষে, সংবাদ হোক ধর্ষকদের ভিত কাঁপানোর অন্যতম হাতিয়ার। অর্থাৎ প্রচারমাধ্যমই পারে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত করতে। একজন ধর্ষিতার উকিলদের প্রতি অনুরোধ রইলো, ধর্ষকের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করুন। উকিলদের প্রতি আরও অনুরোধ রইলো, ধর্ষকদের আইনি সহায়তা না দিয়ে বিনা পয়সায় ধর্ষিতাকে আইনি সহায়তা দিন। ধর্ষকের উকিল হওয়া থেকে বিরত থাকুন। সাংবাদিকরাই পারে ধর্ষকদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করতে। ধর্ষণের বিষয়ে তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট, সমাজে ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করে ও সত্য ঘটনা উদ্ঘাটনে সাহায্য করে।

সবার কাছে অনুরোধ করে শেষ করতে চাই- ধর্ষকদের শিক্ষাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত করুন এবং তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন। আর আসুন, সবাই সমস্বরে বলি- একজন ধর্ষকের মা-বাবা, ভাই-বোন থাকতে নেই।

লে. কর্নেল মো. সাইফুল ইসলাম : সেনাসদর, কিউএমজির শাখা (এসটি পরিদফতর)

mdsaifulislam99@yahoo.com

সৌজন্যে: যুগান্তর

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক

Development by: webnewsdesign.com