বরগুনা শহরে প্রকাশ্য রাস্তায় শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; যাদের মধ্যে একজন পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
জেলার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন জানান, শনিবার সন্ধ্যা থেকে গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত বরগুনা, পটুয়াখালী ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। আটক তানভির, ফাহিমুল ও সাগরের নাম এজাহারে নেই।
পুলিশ সুপার গতকাল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় বরগুনা শহর থেকে তানভিরকে, পটুয়াখালী শহর থেকে ফাহিমুলকে আর গতকাল রোববার সকালে ঢাকা থেকে সাগরকে গ্রেপ্তার করা হয়। “তাদের সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
এর আগে নাজমুল নামে আরও এক সন্দেহভাজনকে এবং চন্দন ও হাসান নামে দুই এজাহারভুক্ত আসামীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বুধবার জেলা শহরের কলেজ রোডে রিফাত শরীফকে (২৩) স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে জখম করে একদল লোক। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তার বাবা দুলাল শরীফ বৃহস্পতিবার ১২ জনকে আসামী করে বরগুনা থানায় মামলা করেন।
আটককৃতদের মধ্যে সাগর পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন। সাগর সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল লতিফ মাস্টারের ছেলে। বর্তমানে তার পরিবার বরগুনা পৌরসভার পশ্চিম আমতলা পাড় সড়কে বসবাস করছে।
সাগর ০০৭ গ্রুপেরই
রিফাত হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মো. সাগর নামে যাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ , সেই রিফাত হত্যার আগের রাতে নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে পরিচালিত মেসেঞ্জার গ্রুপ ০০৭-এ যে পরিকল্পনা হয়, তাতেও অংশ নিয়েছিলো। জানা গেছে, পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছিলেন এই সাগর। রিফাতের পরিবারের অভিযোগ, নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগের রাতেই ০০৭ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে ওই হত্যার পরিকল্পনা হয়। ওই গ্রুপের কথোপকথনের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেসব কথোপকথনেই দেখা যায়, সাগর নামে একজন রয়েছেন সেই গ্রুপে।
রিফাত হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ০০৭ মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথনে দেখা যায়, রিফাতকে হত্যার দিন সকাল ৮টা ৬ মিনিটে রিফাত হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী (নয়ন বন্ডের ০০৭ গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত) গ্রুপে লেখেন, ‘০০৭-এর সবাইরে কলেজে দেখতে চাই।’ এর উত্তরে ‘Mohammad’ নামে একজন জানতে চান, ‘কয়টায়?’ আর ফরাজীর ওই নির্দেশনায় সাগর উপস্থিত থাকার সম্মতি জানান, বিজয়সূচক ‘ভি’ (V) প্রতীকও দেন।
মো. সাগর নিজেও ০০৭ গ্রুপে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি বলছেন, তাকে জোর করে এই গ্রুপে যোগ করা হয়েছে। তাছাড়া রিফাত হত্যার সময় তিনি বরগুনা কলেজ এলাকায় উপস্থিত ছিলেন না বলেও দাবি করেছেন।
বরগুনায় পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফল মিলিয়ে তৈরি মেধাতালিকায় ১৮তম হয়েছেন সাগর। পরীক্ষায় তার রোল ছিল ১০৮, পরীক্ষায় ৪০ নম্বর পেয়েছিলেন তিনি। গতকালই রোববার বরগুনা পুলিশ লাইনে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তবে তার আগেই গ্রেফতার হলেন তিনি।
ফেসবুকে বাড়ছে মিন্নি নামের আইডি, ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি
দিবালোকে স্বামী শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে নিয়ে নানান গুজব ছাড়া হচ্ছে বলে দাবি স্বজনদের। এরইমধ্যে মিন্নির ছবি দিয়ে নামও ঠিক রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোলা হয়েছে বেশ কিছু আইডি। পাশাপাশি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই নানান অভিযোগ তোলা হচ্ছে, দেওয়া হচ্ছে নানান সংবাদ। যা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে খোদ প্রশাসনসহ মিন্নি ও রিফাতের পরিবার এবং স্থানীয়দের।
রিফাতের হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন মিন্নিকে নিয়ে তোলপাড় চলছে, তেমনি শনিবার (২৯ জুন) থেকে শুরু হয়েছে নানান ধরনের গুজব ছড়ানো। যারমধ্যে কখনও নগরের নতুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে নয়ন বন্ডকে আটকের গুজব, আবার কখনো সয়ং বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবির মোহাম্মদ হোসেনকে প্রত্যাহারের খবরও ছড়িয়ে পড়ছে।
ফলে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের থেকেও এসব বিষয় সামনে চলে আসছে, যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এ মুহুর্তে রিফাতের হত্যাকারীদের গ্রেফতারের থেকে কোনো বিষয় নিয়ে ভাবছেন না তারা। তবে কিছু ঘটনার কারণ যে পরবর্তীতে খতিয়ে দেখা হবে তারও ইঙ্গিত রয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এদিকে রিফাত হত্যার পর থেকেই জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে আসছেন তার বাবা-মা, স্ত্রী-শশুরসহ স্বজনরা। মিন্নির মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বা বিভিন্নভাবে তার বিরুদ্ধে যে লেখালেখি বা কথা ছড়ানো হচ্ছে, তা সত্য নয়। যারা এ কাজ করছেন তারা হত্যাকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খতিয়ে দেখলে খুনিদের সঙ্গে অপপ্রচারকারীদেরও সম্পৃক্ততা পাবে বলেও আশা করেন মিন্নি।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর জানান, আগে থেকেই নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা নানাভাবে আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলো। তারা নানানভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, এই নিয়ে আমরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। মিন্নি একা তার স্বামীকে বাচানোর চেষ্টা করেছে, তারপরও শেষ রক্ষা করতে পারেনি, অল্প বয়সে বিয়ের ২ মাসের মাথায় বিধবা হলো সে। আমরা চাই রিফাতের হত্যাকারীদের ফাঁসি হোক।
অপরদিকে, মিন্নির স্বজনদের দাবী, নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা বিয়ের আগে ও পরে রাস্তাঘাটে নানানভাবে মিন্নিকে বিরক্ত করতো। হুমকি-ধমকি দিয়ে জোর করে নানান কাজ করিয়ে নিতো। নয়ন বন্ডদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই কোনো প্রতিবাদ করার সাহস ছিলো না করো। তাই মিন্নির পরিবারকেও চুপ করেই সইতে হয়েছে সব।
আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখে খুনিদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে: মিন্নি
হত্যাকান্ডের সময় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি তাকে বাঁচানোর শত চেষ্টা করেও সফল হননি। মিন্নি ছাড়া কেউ রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নৃশংস এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছেন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। কেউ কেউ এ হত্যাকান্ডের নেপথ্যে রিফাতের স্ত্রীর সঙ্গে অভিযুক্ত ঘাতক নয়ন বন্ডের সম্পর্কের দিকটি দায়ী বলে ইঙ্গিত করেছেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন নববধূ মিন্নি। তিনি বলেছেন, ‘ফেসবুকে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি হচ্ছে বলে আমি শুনেছি। এসব যারা করছেন, তারা সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর জন্য আমাকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করছেন। এই হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে এরাও খুনের সঙ্গে জড়িত বলে আমি মনে করি। প্রধানমন্ত্রী ও এ দেশের মানুষের কাছে আমার একটিই দাবি- যারা এমন আজেবাজে কথা বলছেন, তাদের যেন শাস্তি দেয়া হয়।’ শনিবার রাত ৮টার দিকে বরগুনা পৌর শহরের মাইঠা এলাকায় নিজ বাসভবনে গণমাধ্যমকে এসব কথা বলেন তিনি।
রিফাতকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন জানিয়ে মিন্নি বলেন, ‘আমাদের বিয়ের বয়স দুই মাস। কিন্তু দুই-তিন বছর আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। আমরা একজন-আরেকজনকে ভালোবাসতাম। বিষয়টি আমাদের পরিবারকে জানালে দুই মাস আগে আমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। আমার স্বামীকে সন্ত্রাসীরা চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করল।’
নয়ন দীর্ঘদিন ধরে তাকে উত্ত্যক্ত করে আসছেন জানিয়ে মিন্নি বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি- বিয়ের আগে ও পরে নয়ন আমাকে রাস্তাঘাটে বিরক্ত করত। জোর করে আমার রিকশায় ওঠত। আমার সঙ্গে ছবি তুলত।’
এসব জেনেও যারা রিফাত হত্যায় নয়ন-মিন্নির কথিত সম্পর্ককে দায়ী করছেন, সেসব ফেসবুক স্ট্যাটাসকারীদের উদ্দেশ্যে স্বামীহারা এই গৃহবধূ বলেন, ‘ভাই, আপনারা এসব বাদ দিয়ে একটু খুনিদের ধরতে সহযোগিতা করুন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুক্রবার বিকালে বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা সাংবাদিকদের জানানোর কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আমি প্রেসক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে পারিনি।’
নৃশংস এই হত্যকান্ডে জড়িত সবার ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
নিহত রিফাত শরীফের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬নং বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে। তার বাবার নাম আ. হালিম দুলাল শরীফ। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন রিফাত।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |
Development by: webnewsdesign.com