উপবন ট্রেনেই মেধাবী ইভার স্বপ্নের মর্মান্তিক সমাধি

মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০১৯ | ১০:৩৪ অপরাহ্ণ | 1121

উপবন ট্রেনেই মেধাবী ইভার স্বপ্নের মর্মান্তিক সমাধি

আব্দুল্লাহপুর-জালালপুর থেকে ফিরে ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে বারটা ছুঁইছুঁই। ইভা’দের বাড়ির প্রবেশপথে ঢুকতেই কানে ভেসে এল কান্নার সুর। হাউমাউ করে কাঁদছেন ইভার স্বজনরা। তাদের কান্নায় তখন সর্বত্র নীরবতা।

বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখলাম ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভাকে জীবনের শেষ গোসল দেওয়াচ্ছেন নিকট আত্বীয়রা। লোকজনের ভীড় প্রচন্ড রকম। দক্ষিণ সুরমার জালালপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সকল বয়সের মানুষ যেন ছুটে এসেছেন ইভাদের বাড়িতে। সকলের চোখেই কান্না। কে কাকে শান্তনা দেবে। আচমকা এমন মৃত্যু যেন মেনে নিতে পারছেননা কেউই। কি থেকে কি হয়ে গেল? এমন মেধাবী মেয়েটি অসময়ে চলে গেল? এমন নান প্রশ্ন সবার মুখে। বাকরুদ্ধ স্বজনরা শুধুই কান্না করছেন।

কুলাউড়ার বরমচালে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় বোন মারা গেছেন এমনটি ভাবতেই পারছেনা ইভার ছোট ভাই সিলেট টেকনিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুস সালাম। এ প্রতিবেককে দেখেই সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, গত শুক্রবারেই তো ছুটি কাটিয়ে কলেজের হোস্টেলে গেছে আপু। রোববার রাতে আব্বার সাথে শেষ কথা হয় আপুর বলেছিলেন নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনযোগে তারা কয়েকজন ঢাকা যাচ্ছেন।

রাতে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আপুর মোবাইলে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তখন আমাদের সন্দেহ বাড়তে থাকে। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল বন্ধ পেয়ে আমার বড় ভাইসহ স্বজনরা কুলাউড়া যান। সেখানে গিয়ে তারা হাসপাতালে লাশ সনাক্ত করেন। তবে তার আগেই আমাদের এক আত্বীয় ফেইসবুকে ছবি দেখে যুক্তরাজ্য থেকে আমাদেরকে সংবাদটি দেন। সবাই কান্না করবেন ভেবে প্রথমে জানাইনি।

পরে ভাইয়া লাশ সনাক্ত করে সবাইকে জানান। সামাদ বলেন, ইভা আপু বাড়িতে আসলে অনেক মজা হত। তিনি আমাদের অনেক যত্ন নিতেন। প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করেছেন।

সিলেট সরকারী নার্সিং কলেজে ভর্তি হতে পেরে অনেক খুশি হয়েছিলেন তিনি। তার স্বপ্ন ছিল বিএসসি নার্সিং করে সরকারী কোন হাসপাতালে চাকুরি নিয়ে মানুষের সেবা করবেন। আমরা ও অনেক আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু কে জানতো এমন স্বপ্নের সমাধি এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সামাদ। সামাদের আর্তনাদে সবাই নীরব নিশ্চুপ। কারণ এ আর্তনাদ যে বোনকে হারানো ভাইয়ের। ভাই বোনের নিখাদ ভালবাসার আর্তনাদ এটি।

ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা ২০১৪ সালে জালালপুর ইউনিয়নের বৈরাগী বাজার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ২০১৬ সালে জালালপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন সিলেট সরকারী নার্সিং কলেজে।

বিএসসি নার্সিং ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী ইভা একটি প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকজন সহপাঠীর সাথে রোববার রাতের উপবন ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তাদের ট্রেন বরমচালে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ঘটনার সাথে সাথে ইভা আর তার সহপাঠী সানজিদা আক্তার ট্রেনের জানালা দিয়ে লাফ দেন। এতে তারা দু’জনে ট্রেনের নিচে পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

ইভার বাড়ির আঙ্গিনায় বসে কথা হয় তার চাচাতো ভাই ছাত্রলীগ নেতা হাসানের সাথে। হাসান বললেন, ইভা অনেক মেধাবী ছিল। জীবনের সকল পরীক্ষায় সে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। এলাকার সবাই তার প্রশংসা করতো। এমন মেধাবী একটি মেয়ের অকাল মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছেননা।

ইভার বড় ভাই আব্দুল হামিদ। নিজেদেরে প্রাইভেটকার চালান তিনি। এ প্রতিবেদককে শুধু বললেন, সবাই আমার বোনের জন্য দোয়া করবেন। সে অনেক মেধাবী ছিল। পরিবারের সকলের খোঁজ খবর রাখতো। আমাদের পরিবারটি এখন সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়বে। ইভার পিতা আব্দুল বারীকে শান্তনা দেয়ার ভাষা কারো নেই। দুই মেয়ের একজনকে হারিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বেশ আগে। স্বপ্ন ছিল ছোট মেয়েটা নার্সিং পাশ করে সরকারী চাকুরী করবে। তারপর বিয়ে দেবেন। কিন্তু তার স্বপ্ন যেন মাঝপথেই ভেঙ্গে গেল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি শুধু ইভাকেই ডাকছিলেন।

ইভার মমতাময়ী মা রহিমা খানম একতলা বাড়ির গ্রীলে ধরে বিলাপ করছিলেন। উনাকে স্বজনরা কিছুতেই শান্তনা দিতে পারছেননা। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।

ইভার ছোট ভাই স্থানীয় বৈরাগী বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র মাহিম তার বোনের কথা মনে হলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। এ প্রতিবেদককে মাহিম বলেন, আমার আপু অনেক ভাল ছিল। সে বাড়িতে আসলে অনেক বেশি আনন্দ হতো। গত শুক্রবার আপু বাড়ি থেকে হোস্টেলে যায়। আমি আপুকে ছাড়া থাকতে পারবোনা বলেই আবার সে কান্না করে।

সোমবার সকাল ১১ টায় ইভার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় স্বজনদের কান্নায় আব্দুল্লাহপুর গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠে। লাশ আসার খবর শুনে লোকজন ভীড় করেন ইভার বাড়িতে। বেলা ১ টার দিকে ইভার সহপাঠী, শিক্ষক শিক্ষিকারা তাকে শেষবারের মত একনজর দেখতে আব্দুল্লাহপুর আসেন।

সিলেট সরকারী নার্সিং কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের লম্বা লাইন দেখা যায় ইভার বাড়ি অভিমুখে। আব্দুল্লাহপুর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় ইভার সহপাঠী তাম্মির সাথে।

নরসিংদীর মেয়ে তাম্মি বলেন, ইভা অনেক মেধাবী ছিল । ও এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই পারছিনা। অনেক শান্ত স্বভাবের মেয়ে ইভা। আমরা ওকে হারিয়ে যেন সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। শেষবারের মত ইভাকে দেখতে তাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছি। অথচ কথা ছিল বেড়াতে আসার। সব ইচ্ছা মহান মাবুদের।

আরেক সহপাঠী ফাহিমা বলেন, ইভা প্রচন্ড রকম মেধাবী আর ভদ্র স্বভাবের। ওর চলাফেরা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমন ভাল মেয়েটি অসময়েই চলে গেল।

ইভার উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষক জালালপুর ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আওলাদ হোসেন বলেন, ও যখন আমাদের কলেজে পড়তো তার আচার আচরণ চলাফেরা দেখে আমি খোঁজ নিয়েছিলাম সে কার মেয়ে। পরক্ষণে জানতে পারলাম আব্দুল বারীর সুযোগ্য কন্যা সে। আমার কলেজ থেকে ইভা বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়েছে। আমি তাঁর এমন অকাল মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তাকে যেন আল্লাহ বেহেস্ত নসিব করেন। আর তার পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দেন।

ইভার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা সুলাইমান হোসেন। তিনি ইভার আত্বার মাগফেরাত কামনা করেছেন।

রোববার আছরের নামাজের পর নিজ জালালপুর ঈদগাহ মাঠে ইভার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক

Development by: webnewsdesign.com