কুলাউড়ায় ৩ প্রতারকের কাছে জিম্মি পল্লীবিদ্যুতের শত শত গ্রাহক!

বুধবার, ০৮ জুলাই ২০২০ | ৯:১০ অপরাহ্ণ | 1496

কুলাউড়ায় ৩ প্রতারকের কাছে জিম্মি পল্লীবিদ্যুতের শত শত গ্রাহক!

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার টিলাগাঁও ইউনিয়নে পল্লীবিদ্যুতের এক লাইসেন্সধারী ইলেক্ট্রিশিয়ান ও পল্লীবিদ্যুতের লোক নামধারী দুই দালালের খপ্পরে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন শত শত বিদ্যুৎ গ্রাহক। তাদের অবৈধ কর্মকান্ডে গ্রাহকরা অতিষ্ট হয়ে উঠছেন। স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন ও নতুন মিটার দেওয়া এবং পুরাতন মিটার গ্রাহকের সুবিধামত জায়গায় স্থানান্তরের কথা বলে ৩/৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩০/৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত গ্রামের সহজ সরল গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনজনের এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকের সাথে প্রতারনা করে আসছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে গ্রাহকের কাছ থেকে খুঁটি ও মিটার দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। কাজের প্রকার ভেদে কখনও পল্লীবিদ্যুৎ খুঁটির ঠিকাদারের লোক, কখনও জিএম, ডিজিএম আবার কখনও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির পরিচালকের সাথে তাদের সুসম্পর্কের কথা জানিয়ে কিংবা তাদের যে কারো দোহাই দিয়ে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে এবং দ্রæত সময়ে কাজ সেরে দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকের কাছ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা আদায় করে নেয় তারা। অনেক ক্ষেত্রে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও গ্রাহকরা বৈদ্যুতিক খুঁটি কিংবা নতুন মিটার পাননি। আবার কোন কোন গ্রাহকের খুঁটিসহ মিটার স্থাপন কিংবা তা স্থানান্তর করে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ দিলেও পরক্ষণে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ এনে পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের লোকজন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এতে করে গ্রাহকদের দুর্ভোগের কোন শেষ নেই। টিলাগাঁও ইউনিয়নসহ পাশর্^বর্তী ইউনিয়নের লোকজনও এই চক্রটির অবৈধ কর্মকান্ডে অতিষ্ট। তাদের অবৈধ কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্ন সময় মানুষ এই চক্রের কোন না কোন জনকে উত্তম মধ্যম দিয়েছেন এমন খবরও পাওয়া গেছে অহরহ। অনেক গ্রাহক চক্রটির দ্বারা হয়রানির শিকার হয়ে তাদের বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি’র চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। অনেক জায়গায় তাদের কর্মকান্ড নিয়ে গ্রাহকদের সাথে শালিসী বৈঠক হতেও শোনা গেছে। এরপরও তাদের লাগাম টেনে ধরে রাখা যাচ্ছেনা। তারা এতটাই বেপরোয়া যে, স্থানীয় প্রশাসনসহ পল্লীবিদ্যুতের কোনো কর্মকর্তাদেরও যেন তোয়াক্কা করছেনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চক্রে রয়েছেন টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়গ্রামের আব্দুল ওহাবের ছেলে আতাউর রহমান রাজু (৩৫), ডরিতাজপুর গ্রামের আব্দুল মালিকের ছেলে আক্তার হোসেন (২৯) ও লংলা খাস এলাকার আব্দুর রহিমের ছেলে ময়নুল আহমদ (২৭)। এদের মধ্যে পল্লীবিদ্যুতের লাইসেন্সধারী ইলেক্ট্রিশিয়ান আতাউর রহমান রাজু। আক্তার হোসেন ও ময়নুল আহমদ এক সময় বিদ্যুতের খুঁটির ঠিকাদারদের অধীনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন বলে জানা গেছে। কিন্তু দালালির কারণে জনৈক ঠিকাদাররা তাদের দু’জনকে কাজের সাইড থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন। বর্তমানে তারা গ্রাহকদের হয়রানি করছেন বিভিন্নভাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক গ্রাহক জানান, ইলেক্ট্রিশিয়ান রাজু নতুন মিটার দেওয়া কিংবা মিটার স্থানান্তর করে দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। টাকা নেওয়ার পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে মিটার দিবে বললেও পরবর্তী সময়ে আর কোন গ্রাহকের ফোন রিসিভ করে না সে। এতে করে গ্রাহকরা হয়রানির শিকার হয়ে স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যান, পল্লীবিদ্যুতের জিএম ও ডিজিএম বরাবরে অভিযোগ দাখিল করেছেন। অনেক স্থানে গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছেন।
টিলাগাঁও ইউনিয়নের বাগৃহাল গ্রামের ওয়াছির মিয়ার স্ত্রী রিনা বেগম ইউপি’র চেয়ারম্যান বরাবরে দায়েরকৃত অভিযোগে উল্লেখ করেন, তিনি আবেদন করে পল্লীবিদ্যুতের খুঁটি এনেছেন। শ্রমিকরা খুঁটি স্থাপন করতে গেলে রাজু তাতে বাধা দেয়। একপর্যায়ে ১০ হাজার টাকা তাকে দিলে খুঁটি বসাতে পারবেন বলে সে জানিয়ে দেয়। এ ঘটনায় উপস্থিত লোকজন তাকে সেখানে (ওয়াছির মিয়ার বাড়িতে) উত্তম-মধ্যম দেয়। তারাপাশা চা বাগানের সুরেশ নাইডু, জগন্নাথ নাইডু ও আপানা নাইডু জানান, বৈদ্যুতিক মিটারের জন্য প্রায় ২ বছর আগে ৬ হাজার টাকা রাজুর কাছে দিলেও রাজু মিটার দেয়নি। পরে তারা নিজেরা অফিসে আবেদন করে নতুন মিটার আনতে সক্ষম হন। লালপুর গ্রামের ছিদ্দেকুর রহমানের স্ত্রী রেজিয়া বেগম অভিযোগে উল্লেখ করে বলেন, রাজু নতুন মিটার দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে প্রথমে ১ হাজার টাকা, পরে আরো ২ হাজার টাকা দাবি করে। এছাড়া আমানীপুর গ্রামের খোকন মিয়ার নিকট থেকে নতুন মিটার দেওয়ার কথা বলে ৫ হাজার টাকা নেয় রাজু। এরকম অনেকেই তার কাছে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হয়রানির শিকার গ্রাহকরা রাজুর বেপরোয়া অবৈধ কর্মকান্ডের জন্য পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে তার লাইসেন্স বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

এই চক্রের অপর সদস্য আক্তার হোসেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির নাম ভাঙ্গিয়ে সহজে খুঁটি কিংবা মিটার স্থাপনের কাজ করে দেওয়ার কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে অনেকটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে লেন-দেনের কাজ করে। বিদ্যুতের পাকা খুঁটি বসিয়ে দিতে ও মিটার স্থানান্তরের জন্য এক গ্রাহকের কাছে ৩৫ হাজার টাকা চেয়েছে আক্তার হোসেন। পরবর্তীতে ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে কাঠের খুঁটি বসিয়ে দেয়। অবৈধভাবে মিটার স্থানান্তর করে দেওয়ায় গ্রাহকের বিদ্যুৎ লাইন প্রায় ১ মাস যাবৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ওই গ্রাহক টিলাগাঁও ইউনিয়নের বাগৃহাল গ্রামের শামীম আহমদের স্ত্রী হাবিবুন আক্তার হেপী প্রতিকার চেয়ে গত ১১ জুন আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে পল্লীবিদ্যুতের ডিজিএম বরাবরে একটি অভিযোগ করেছেন। হাবিবুন আক্তার হেপীর লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, তার মিটার (নং ৪৮৫/৩৬৯৫) পুরনো ঘরে স্থাপিত ছিল। নতুন ঘরে দুরত্ব ১৩০ ফুটের বেশি থাকায় একটি সার্ভিস খুঁটি বসানোর ব্যাপারে ডিজিএম বরাবরে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেখানে আক্তার হোসেন স্বল্প সময়ের মধ্যে খুঁটি দেওয়ার কথা বলে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেন। পরবর্তীতে ২০ হাজার টাকা চুক্তি করেন আক্তার। হাবিবুন আক্তার হেপীর দাবি, ২০ মে চুক্তির টাকা নেওয়ার পর সার্ভিস খুঁটি হিসেবে একটি বড় কাঠের খুঁটি স্থাপন করে লাইন টানেন আক্তার হোসেন। ওই খুঁটি থেকেই স্থানান্তরিত মিটারে লাইন সংযোগ দেন। তাকে পাকা খুঁটির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি অফিসে খুঁটির সংকট রয়েছে বলে জানান।

এদিকে কাঠের খুঁটি স্থাপন এবং মিটার স্থানান্তর অবৈধ, এমন অভিযোগ এনে ৩০ মে লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন টিলাগাঁও অভিযোগ কেন্দ্রের ইনচার্য মঈন উদ্দিন আহমেদ। লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি হাবিবুন আক্তার হেপি তাৎক্ষণিক আক্তার হোসেনকে জানালে জিএম এবং ডিজিএম এর দোহাই দিয়ে ৩১ মে আক্তার পুনরায় বিদ্যুৎ লাইন সংযোগ দেন। ফের সংযোগের খবর পেয়ে ইনচার্য মঈন উদ্দিন আহমদ গত ৮ জুন হাবিবুন আক্তার হেপির বৈদ্যুতিক লাইন পুনরায় বিচ্ছিন্ন করে মিটার তুলে নিয়ে আসেন। বর্তমানে ওই পরিবারটি ২৪ দিন ধরে অন্ধকারে রাতযাপন করছেন।
এদিকে গত ২৯ জুন হাজিপুর ইউনিয়নের হাজিপুর গ্রামে পল্লীবিদ্যুতের লোকজন স্থানীয়দের সহায়তায় বৈদ্যুতিক চোরাই খুঁটিসহ হাতে-নাতে আটক করেন ময়নুল আহমদকে। পরে তাকে কুলাউড়া থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর মৌলভীবাজার জেল হাজতে প্রেরণ করা হয় ময়নুল আহমদকে।

কুলাউড়া থানার এসআই কানাই লাল চক্রবর্তী সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, চোরাই খুঁটির সাথে জড়িতদের লম্বা চেইন রয়েছে। তিনি বলেন, আটক ময়নুলকে জিজ্ঞাসা করার পরেও বলতে পারেনি খুঁটি কোন ঠিকাদারের কাছ থেকে এনেছে। এতে স্পষ্ট যে, এটি চোরাইকৃত খুঁটি। ময়নুল একজন পেশাদার দালাল বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আর এই চক্রে যারাই রয়েছে তারা মানুষের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে প্রতারনা করে টাকা আদায় করে নিচ্ছেন। এদিকে আটক ময়নুলকে মৌলভীবাজার আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

পল্লীবিদ্যুৎ মৌলভীবাজার জোনাল অফিসের ডিজিএম প্রকৌশলী গণেশ চন্দ্র দাশ জানান, টিলাগাঁওয়ের বাগৃহাল গ্রামের হাবিবুন আক্তার হেপির একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। সেখানে খুঁটি স্থাপনসহ মিটার স্থানান্তর করা হলো কিভাবে তা বোধগম্য হচ্ছেনা। তাছাড়া ময়নুল আহমদ এবং আক্তার হোসেন পল্লীবিদ্যুতের সাথে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নন বলেও তিনি জানান। তাছাড়া জুন মাস থাকায় বাগৃহাল গ্রামে খুঁিট স্থাপন এবং মিটার স্থানান্তরের ঘটনাটি পুরোপুরিভাবে তদন্ত হয়নি। তবে এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের একটি লম্বা গ্যাং থাকতে পারে বলে তার ধারনা। তিনি আরো জানান, আমরা ঘটনাটি আরো অধিক তদন্ত করতেছি। জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক

Development by: webnewsdesign.com