আগের দুই মেয়াদে সরকারের অংশীদারিত্ব পেলেও বর্তমান মন্ত্রিসভায় ঠাঁই মেলেনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ)। দলের বিভক্তির কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন সংখ্যাও কমে গেছে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এই দলটির। আলাদা দল গঠন করে জাসদের একটি অংশের নেতারা বেশ তৎপর, যা মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও বিভক্ত করে রেখেছে। এ অবস্থায় নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে তৎপরতা শুরু করেছে জাসদ।
নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় থেকে মাঠ গোছানোর এই তৎপরতায় জাসদ আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দলের জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর আগে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে জেলা সম্মেলন এবং ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন শেষ করার টার্গেট রয়েছে তাদের। শরিক হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণও রয়েছে তাদের। যদিও ১৪ দলের ‘অবহেলা’ ও ‘অবমূল্যায়ন’-এ খানিকটা ক্ষুব্ধ দলের নেতারা। এরই মধ্যে নতুন কর্মসূচি হিসেবে ‘সুশাসনের জন্য রাজনৈতিক চুক্তি’র দাবিতে মাঠে নেমেছে দলটি। গত ৩১ জুলাই ‘সুশাসন দিবস’ ঘোষণা করে এই কর্মসূচির উদ্বোধনের পর দেশজুড়ে ধারাবাহিকভাবে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সত্যিকারের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতি রোধের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই তাদের এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য বলে দাবি দলীয় নেতাদের।
নেতারা বলছেন, ২০০৫ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল জাসদের। আর জোট গঠনের পর থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন তারা। এই আন্দোলনের সফলতার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটসহ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তিকে পরাজিত করে ১৪ দল ক্ষমতায় আসে। গত দু’নির্বাচনেও ১৪ দলসহ মহাজোটের নিরঙ্কুশ জয়ের পেছনেও অন্য শরিক দলগুলোর মতো জাসদেরও অবদান ছিল। অথচ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ অন্য শরিকদের নানাভাবে ‘অবহেলা’ ও ‘অবমূল্যায়ন’ করে চলেছে। টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে সেই ‘অবহেলা’ চূড়ান্ত রূপ পায়। এ অবস্থায় শরিক দলগুলোর নিজস্ব শক্তিকে সুসংহত করে ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয় মেয়াদে মন্ত্রিসভা গঠন করে আওয়ামী লীগ। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনকালে আগের সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ ১৪ দল ও মহাজোট শরিকদের সব মন্ত্রীই বাদ পড়েন। পরে দু’দফায় মন্ত্রিসভার কিছুটা সম্প্রসারণ ও রদবদল হলেও শরিকদের কাউকেই যুক্ত করা হয়নি। অবশ্য মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না মিললেও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কিংবা সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে শরিক দলগুলোর নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের। এর আগে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আসন সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হলে আরেক দফা ‘অবমূল্যায়ন’-এর শিকার হতে হয় জাসদকে। আগের দুটি নির্বাচনে অবিভক্ত জাসদকে গড়ে ছয়টি করে আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে চারটিতে নৌকা এবং বাকি দুটিতে দলীয় প্রতীক মশাল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জাসদ প্রার্থীরা। সব মিলিয়ে পাঁচটি সাধারণ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের একটি মিলিয়ে জাসদের এমপি সংখ্যা ছিল ছয়জন। কিন্তু অনেক দেনদরবারের পর এবারের নির্বাচনে দু’ভাগে বিভক্ত জাসদ মিলিয়ে মাত্র চারটি আসনে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়। বাদ পড়েন বাংলাদেশ জাসদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধানসহ আগের নির্বাচনে বিজয়ীদের কেউ কেউ। শেষ পর্যন্ত দুটি আসনে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এবং আরেকটি আসনে বাংলাদেশ জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দীন খান বাদল জিতেছেন। নিবন্ধন না থাকায় বাংলাদেশ জাসদের প্রার্থী মইনউদ্দীন খান বাদলকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচনে লড়তে হয়।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনের দু’বছর পর জাসদের বিবদমান দুই অংশ নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়িয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৪ দলীয় জোট ও সরকারে থাকা না থাকাসহ দলের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে বিরোধের জের ধরে ২০১৬ সালের ১১ মার্চ অবিভক্ত জাসদের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধনের পর ১২ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে পাল্টাপাল্টি কমিটি ঘোষিত হয়। মূল অংশের বিদায়ী সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে আবারও সভাপতি, কাউন্সিলরদের ভোটে শিরীন আখতারকে সাধারণ সম্পাদক এবং অ্যাডভোকেট রবিউল আলমকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে কাউন্সিল বর্জন করে বিক্ষুব্ধ অংশটি শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে সভাপতি, নাজমুল হক প্রধানকে সাধারণ সম্পাদক এবং মইনউদ্দীন খান বাদলকে কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা দেয়। এরপর কয়েক মাস ধরে দলের প্রবীণ নেতারাসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা দু’অংশের নেতাদের মধ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। এর মধ্যেই ঘটে দলীয় নিবন্ধন, নির্বাচনী প্রতীক ‘মশাল’ এবং দলের কার্যালয়ের দাবি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দায়েরসহ আদালতে মামলার মতো ঘটনাও। অবশ্য পরে নির্বাচন কমিশন থেকে দলীয় নিবন্ধন ও প্রতীক মশাল হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়, উচ্চ আদালতেও তা বহাল থাকে। অন্যদিকে আম্বিয়া-প্রধানের নেতৃত্বাধীন অংশটি বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তথা ‘বাংলাদেশ জাসদ’ নামে আলাদা দলের ব্যানারে ও আলাদা কার্যালয় নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে।
এদিকে, গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরপরই ১৪ দল শরিকদের ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো’ কিংবা সংসদে ‘বিরোধীদলের আসনে বসার’ আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা ১৪ দলের শীর্ষনেত্রী শেখ হাসিনার অনুরূপ বক্তব্য দিলে ক্ষুব্ধ হন জাসদ নেতারা। এটিকে শরিকদের ‘তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য’ করার শামিল বলেই মনে করছেন তারা। নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনে ১৪ দলসহ মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত বিজয় সমাবেশে শরিকদের কাউকে ডাকা কিংবা বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়টিতেও ক্ষুব্ধ হন শরিক নেতারা। কিছুদিন এসব নিয়ে কিছুটা সোচ্চার থাকলেও বর্তমানে অনেকটাই নীরব অবস্থানে থেকে নিজেদের দল ও অবস্থানকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হয়েছেন জাসদ নেতারা।
এ অবস্থায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে নিজস্ব শক্তিতে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থাকার চেষ্টা শুরু করেছে জাসদ। দলের আগামী জাতীয় সম্মেলন এবং জেলা ও সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের মাধ্যমে সারাদেশে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিসহ দলীয় কার্যক্রম আরও জোরদার করতে চায় দলটি। সারাদেশে জাসদের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা এবং ২২০টি উপজেলায় কমিটি রয়েছে। এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে সব জেলা-উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের প্রচেষ্টা চলছে।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি সমকালকে বলেছেন, গত ১০ বছরের অর্জিত বিজয় সুসংহত করা, উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারা বেগবান করা, সুশাসনের কাজ এগিয়ে নেওয়া এবং বৈষম্য কমানো- এই চারটি কারণে আগামী আরও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত ১৪ দলকে বহাল রাখা অপরিহার্য। এই প্রেক্ষাপটে জাসদ দ্ব্যর্থহীনভাবে ১৪ দলকে কার্যকর রাখায় সক্রিয় থাকার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে, দিয়ে যাবে। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ কোন ফর্ম ও শর্তে ১৪ দলের সঙ্গে কাজ করবে অথবা করবে না- সেই অবস্থানটা তাদের শীর্ষনেতা ও নীতিনির্ধারকদেরই পরিস্কার করাই বাঞ্ছনীয়।
তিনি বলেন, মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া অথবা সংসদে আসন সংখ্যা কমলেও দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে রাজনীতিতে জাসদের গুরুত্ব কিংবা প্রভাব একটুও কমেনি, বরং আগের মতোই রয়ে গেছে। জাসদ আগামী জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে আরও সুসংহত ও সুসংগঠিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছে।
সৌজন্যে:: সমকাল
Development by: webnewsdesign.com