রেলে দুর্ঘটনার হার ও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বাড়ছে

সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ৮:২৪ অপরাহ্ণ | 486

রেলে দুর্ঘটনার হার ও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বাড়ছে

নিরাপদ বাহন হিসেবে যাত্রীদের প্রথম আস্থা ট্রেনে। কিন্তু গত কয়েকে বছর ধরে ট্রেন দুর্ঘটনার হার বেড়ে গেছে। পাশাপাশি ট্রেনের ধাক্কায় বা ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুও আগের চেয়ে বেড়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে এক হাজারের বেশি দুর্ঘটনায় ৪১৫ জন হতাহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১১৬ জন নিহত এবং ২৯৫ জন আহত হন। সর্বশেষ গত জুনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় একটি কালভার্ট ভেঙে যাওয়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের ৫ টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এই ঘটনায় চারজনের মৃত্যুসহ শতাধিক হতাহতের ঘটনা ঘটে।

গত ছয় বছরে রেলের দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ১৬৬টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে ১৪ জনের প্রাণহানি এবং ৬২ জন আহত হয়। ২০১৪ সালে ২৪২টি দুর্ঘটনায় নিহত ৫৮ এবং আহত হয়েছেন ১১৯ জন। ২০১৫ সালে ১৫৩টি দুর্ঘটনায় ১৩ নিহত ও ২৫ জন আহত হন। ২০১৬ সালে ১৩ জন নিহত ও ১২ জন আহত হন ১৩১টি দুর্ঘটনায়। ১৪০ দুর্ঘটনায় একজন নিহত এবং ছয়জন আহত হন ২০১৭ সালে। আর ২০১৮ সালে ১৫০টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত এবং ৭১ জন আহত হয়। চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় অর্ধশত।



এছাড়া প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ট্রেনের ধাক্কায় বা ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। রেলওয়ে পুলিশের সূত্রমতে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে রেললাইন থেকে ৫ হাজার ৪৫০ জনের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। ২০১৭ সালে রেলে কাটা পড়ে দুই হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০০ জনে। ২০১৫ সালে মারা গেছেন ৮২১ জন, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৯৭১ এবং ২০১৭ সালে ২ হাজার ১০০ জন। অর্থাৎ মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
জানা গেছে রেলে মৃত্যুর বেশির ভাগই আত্মহত্যা। এ ছাড়া রয়েছে অসচেতনতা বা অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু। অপরাধীরাও হত্যাকা- আড়াল করতে রেললাইনে লাশ ফেলে যায়। উদ্ধার হওয়া এসব লাশের বেশির ভাগেরই পরিচয় পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণ- ট্রেনে কাটা পড়ে লাশ বিকৃত হয়ে যায়। তাছাড়া লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানো হলেও রিপোর্ট পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। নিহতদের মৃতদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলেন, রেললাইন থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ লাশের অবস্থা এমন হয়ে যায়, সেখান থেকে খুনের আলামত সংক্রান্ত কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় না।

ঢাকা রেলওয়ে বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হত্যা মামলা হয়েছে ২১টি। মামলায় উঠে আসে, যাত্রীদের ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করছে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। অন্য জায়গায় খুন করে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা লাশ ফেলে যাচ্ছে রেললাইনে। জানা গেছে, রেললাইনে পাওয়া লাশের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আত্মহত্যা। ১০ শতাংশ অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু। আর ৩০ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে কানে মোবাইল ফোন বা হেডফোন লাগিয়ে অসচেতনভাবে চলাচলের কারণে। বাকি ১০ শতাংশ হত্যা ও অন্যান্য মৃত্যু।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে চলে গেছে সড়ক। এসব লেভেল ক্রসিংয়ের কিছু রেলওয়ে অনুমোদিত। সেখানে রেল কর্তৃপক্ষের নিয়োগ করা কর্মী ট্রেন চলাচলের সময় সড়কে প্রতিবন্ধক (ধাতব বার) ফেলে রাখেন। ফলে সাধারণত ওই এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে না। কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে প্রচুর অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং, যা দিয়ে যান চলাচল করে বা পথচারীরা হেঁটে পার হন। সেসব স্থানে পথচারী বা যানচালকদের সতর্ক করার কেউ থাকে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে এমন অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৩২৮ ও পশ্চিমাঞ্চলে ৩২৬। যেহেতু রেলের তালিকায় এসব ক্রসিং নেই, তাই এতদিন জনবলও নিয়োগ করা যায়নি। তবে এসব লেভেল ক্রসিংকে বৈধতা দিয়ে সেখানে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়ার একটি প্রকল্প এখন চলমান।

এদিকে, সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলো বিশ্নেষণ, সংশ্নিষ্টদের মত ও রেলপথ পুলিশের পর্যবেক্ষণে দুর্ঘটনার কয়েকেটি কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলা বা হেডফোনে গান শুনতে শুনতে রেললাইন পার হওয়া অন্যতম। এ ছাড়া রয়েছে বাঁকা পথের কারণে ট্রেন দেখতে না পাওয়া, রেললাইন ধরে হাঁটা (নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকা স্লিপারে পা ফেলতে হয় বলে সেদিকেই মনোযোগ থাকে), অসতর্ক-অন্যমনস্ক হয়ে পারাপার, আশপাশের প্রচ- শব্দে ট্রেনের শব্দ শুনতে না পাওয়া, রেললাইনের পাশে দোকান বা অবৈধ স্থাপনার কারণে ট্রেন না দেখা এবং রেললাইন বা এর পাশে প্র¯্রাব করতে যাওয়া। এ ছাড়া মানসিক ভারসাম্যহীন বা মাদক সেবনের কারণে ‘অসুস্থ’ ব্যক্তিদের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে রেলপথ পুলিশ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের রেলপথ একেবারেই অনিরাপদ-উন্মুক্ত। ফলে এখানে অপরাধীরাও সহজে পার পেয়ে যায়। রেলে মৃত্যু রোধে রেলওয়ের কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পুরো রেলেই ফাইবার অ্যাপটিক্যাল রয়েছে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা চাইলে পুরো রেলপথ না হলেও চিহ্নিত জায়গাগুলোয় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে পারেন। এতে শুধু হত্যাকা-ই শনাক্ত হবে না, ট্রেন অপারেশন করতে গিয়ে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা-ও চিহ্নিত হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দুর্ঘটনার কারণ শনাক্ত না হওয়া এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় মূলত দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া অনভিজ্ঞ লোকজনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ায় দ্রুত কাজ শেষ করতে পারেন না বলেও মনে করেন তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রেল আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ অবস্থান করতে পারবে না। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেফতারের বিধানও রয়েছে। কিন্তু জনবহুল দেশ হিসেবে বাস্তব কারণেই এজন্য কাউকে আটকের উদাহরণ নেই।

দেশের প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথের ৯৮ শতাংশ এলাকাই রাতে অন্ধকারে ঢাকা থাকে। অনেক এলাকা থাকে নির্জন। অপরাধীরা লাশ গুম করতে এসব অন্ধকার ও নির্জন এলাকা বেছে নেয়। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অপরাধ কমাতে হলে লাইন ঘেঁষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন জরুরি।

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক

Development by: webnewsdesign.com