কদর কমছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ বেতের কুটির শিল্পের

শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ | 106

কদর কমছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ বেতের কুটির শিল্পের

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ

সিলেটের এক সময়ের সম্ভাবনাময় বাঁশ ও বেতের কুটির শিল্প আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে।হরেক রকম প্লাস্টিক পণ্যের অবাধ ব্যবহার,বাশঁ ও বেতের দাম বৃদ্ধিতে এ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে।

মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ ও ঐতিহ্যবাহী বেতশিল্প।দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সিলেটেও বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের কদর একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এই শিল্পটি।এক সময় গ্রামীণ জনপদে মানুষ গৃহস্থালি কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বেত ও বাশেঁর সরঞ্জামাদি ব্যবহার করলেও এখন বিলুপ্তির পথে এ শিল্পটি।বাসা-বাড়ি,অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হত বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র।এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে চিরচেনা চিত্র।তবুও এখনো দেখা যায় কিছু কিছু পরিবার এই ঐতিহ্য ধরে রাখাসহ জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাঁশ আর বেতের শিল্পকে আকড়ে ধরে রেখেছেন একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী।

সরেজমিনে দেখা যায়,মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর কদর দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় এই কুটির শিল্পের প্রতি চাহিদা এখন আর তেমন একটা নেই।তাছাড়াও দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে এ শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ ও বেত।বাজার গুলো দখল করেছে প্লাস্টিক ও এ্যালুম্যানিয়াম।দেখা মিলে না আর স্থরে স্থরে বাঁশ ঝাড়।তাছাড়াও প্লাস্টিক পণ্য স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় যার ফলে সাধারণ মানুষের চোখ মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর ওপর।

এক সময় দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হতো গৃহস্থাথী ও সৌখিন পণ্যসামগ্রী।বাঁশ ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ-বেত কেটে গৃহিনীরা তৈরি করতেন হরেক রকমের পণ্য।এসব পণ্য বিক্রি করেই চলতো তাদের জীবন যাপন।এখনো গ্রামীণ উৎসব ও মেলা গুলোতে বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি খাল,চাটাই,খালুই,ধামা,পাটি, টোনা,পাল্লা,মোড়া,বুক সেল্ফসহ বিভিন্ন জাতের পণ্য চোখে পড়ে।যেখানে তালপাতার হাত পাখারই কদর নেই,সেখানে এসব পণ্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।যতই দিন যাচ্ছে ততই কমে যাচ্ছে এই হস্তশিল্পের চাহিদা।মূল্যবৃদ্ধি,বাঁশ-বেতের দুষ্প্রাপ্যতা আর অন্যদিকে প্লাস্টিক,সিলভার ও মেলামাইন জাতীয় হালকা টেকসই সামগ্রী নাগরিক জীবনে গ্রামীণ হস্তশিল্পের পণ্যকে হটিয়ে দিচ্ছে আস্তে আস্তে করে।গ্রামের বাঁশ-বেত শিল্প বিক্রি করতে আসা এক ব্যবসায়ী বলেন,বাঁশ-বেত শিল্পের দুর্দিনে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক পরিবার এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছে।অনেকে এ পেশা বদলে অন্য পেশায় গেলেও পূর্বপুরুষের হাতেখড়ি পেশাকে কিছুতেই ছাড়তে পারিনি তাই এখনো টুকটাক বেতের সামগ্রী তৈরী করে বিক্রি করছি যানিনা তাও আর কতো দিন করতে পারবো।

মাত্র কয়েক বছর আগেও সিলেটে বেত শিল্প ব্যবসা জমজমাট ছিল।কয়েক বছরের ব্যবধানে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্প হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে।এ পেশার সাথে যুক্ত আছে এমন সহস্রাধিক শ্রমিকের আজ দুর্দিন চলছে।

এক সময় বাংলাদেশের বেতের আসবাপত্রের চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিত সিলেটের বেত শিল্প।অভ্যন্তরিণ চাহিদা পূরণ করে সিলেটের বেতের তৈরি সামগ্রী আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হত।বর্তমানে তা অনেক গুন কমে গেছে।শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ,এক সময় সিলেটে পাহাড় টিলায় প্রচুর বেত পাওয়া যেত।স্থানীয় নাম জালি বেত,গল্লা বেত,অন্না বেত প্রচুর পরিমানে সিলেটে পাওয়া যেত।কিন্তু পাহাড় টিলা কেটে ফেলায় সিলেটের বেত বন উজাড় হয়ে গেছে। তাই পর্যাপ্ত বেত না পাওয়াতে এই শিল্পটি এখন হুমকির মুখে।যাও কিছু বেত পাওয়া যায় তাও চওড়া দামে কিনতে হয় বেত ব্যবসায়ীদেরকে যার কারনে অনেক বেত ব্যবসায়ী তাদের বাপ-দাদার এই ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে।

মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আগেও সিলেটে বেতের আসবাপত্রের দোকান ছিল শতাধিক।এখন সেই বেত শিল্পের দোকান যেমন কমেছে,সাথে শ্রমিকের সংখ্যাও কমে গেছে।শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে পড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন।২০ বছর পূর্বে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) এর উদ্যোগে সিলেটে নগরীর ঘাসিটুলা এলাকায় একটি বেতশিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়।কিছুদিন পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়।এরপর অনেকেই ব্যাক্তিগত উদ্যোগে এই শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখেন।এখনো ছোট ছোট আকারে কেউ কেউ ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্যবাহী বেত শিল্পকে।

সিলেট এক সময় বেতের জন্য বিখ্যাত ছিল।সিলেটে ১৮৮৫ সালে প্রথম বেতের ফার্নিচার ম্যানুফেকচার হয়।১৯২৬ সাল পর্যন্ত সিলেটের বনাঞ্চলে প্রচুর বেত পাওয়া যেত।যদিও পরবর্তীতে সিলেট অঞ্চলে বেতের উৎপাদন কমে আসতে থাকে।বর্তমানে উৎপাদিত বেতে চাহিদা পূরন না হওয়ায় বিদেশ থেকেও বেত আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে দাম বেশি পড়ায় ব্যবসয়ীরা এই শিল্পে লোকসান দিচ্ছেন।

সিলেটে বর্তমানে কয়েকটি দোকানে প্রায় ৫০ প্রকারের বেত জাতীয় পণ্য তৈরী হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বেতের তৈরী ম্যাগাজিন র‌্যাক,টেলিফোন চেয়ার,সোফা সেট,বেড সেট,স্যুজ রেক,ট্রলি,টেবিল,শেলফ,রিডিং টেবিল,রকিং চেয়ার,টেলিফোন টেবিল,ফোল্ডিং চেয়ার,আর্ম চেয়ার,রাউন্ড কফি টেবিল,কর্ণার সোফা এন্ড ইজি চেয়ার, ফুল ইজি চেয়ার,ডাইনিং সেট,টি ট্রলি,গার্ডেন চেয়ার,পেপার বাস্কেট,বুক শেলফ, ম্যাগাজিন বাস্কেট,ডাইনিং চেয়ার,বাঙ্গি টেবিল,কোর্ট হ্যাঙ্গার,মোড়া,বেবী কট,বোতল র‌্যাক ও প্ল্যান্টার,দোলনাসহ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সো পিস।এর বেশীর ভাগই ইংল্যান্ডে রপ্তানী করা হয়।সেই সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয় এই বেত সামগ্রী।

এখনও এই ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা মনে করছেন,সিলেটে আবার বেত উৎপাদন করলে বছর দশেকের মধ্যে এই শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।এতে বেতের তৈরি আসবাবপত্র রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

কুটির শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন জানান,৯০র দশকে হস্তজাত শিল্প ব্যাপক চাহিদা ছিল।দেশেও বিপণন নীতি উন্নত না হওয়ায় এবং প্লাস্টিকের সহজলভ্যতায় এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।সরকার প্রণোদনার আকারে স্বল্প সুদে ঋণ দিলেও বিভিন্ন শর্ত থাকায় এ শিল্পের শিল্পীরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন।

তারা বলেন,প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য সামগ্রীর অবাধ ব্যবহার ও সহজলভ্যতায় দেশীয় বাজারে বাঁশ বেত শিল্পের চাহিদা নেই বললেই চলে।ফলে এ শিল্পের সাথে আমরা জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে শ্রমিক,মজুর,স্বর্ণের কারিগর সহ বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছি।এভাবে শত বছরের ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে।কেউ কেউ বাপ-দাদার অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করলেও আমাদের অবস্থা একেবারেই করুণ।

ঐতিহ্যবাহী শিল্পের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা,প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার কমানো,প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা,প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক

Development by: webnewsdesign.com